বুধবার, ৫ মে, ২০২১

সুখের অসুখ

কেউ কোনো প্রতিযোগিতায় ভালো করলে আমাদের হিংসে হয়। কেউ পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলে আমাদের হিংসে হয়। কেউ ভালো চাকরি পেলে আমাদের হিংসে হয়। কারও উন্নতিতে আমরা দুঃখ পাই। কারও অবনতিতে আমরা মনে মনে একধরনের পৈশাচিক আনন্দবোধ করি। আমরা যতটা না নিজেদের উন্নতি নিয়ে ভাবি তার চেয়ে বেশি ভাবি অপরের অবনতি নিয়ে। 

শৈশবে এক গল্পে শুনেছিলাম— এক ব্যক্তি ভাগ্যদেবীর কাছে প্রার্থনা করে বলেছে, “আমার অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে দাও।” ভাগ্যদেবী তার প্রার্থনা কবুল করলেন তবে এক শর্তে। শর্তটা হলো, যদি তার অবস্থার উন্নতি হয় তবে তার প্রতিবেশীর অবস্থা তার থেকে দ্বিগুণ উন্নীত হবে। অর্থাৎ তার যা হবে তার প্রতিবেশীর তা দ্বিগুণ হবে। তার যদি একটা বাড়ি হয় তার প্রতিবেশীর দুটো বাড়ি হবে, তার যদি একটা গাড়ি হয় তার প্রতিবেশীর দুটো গাড়ি হবে। সে শর্তে রাজি হয়ে এভাবে প্রায় সবকিছুই ভাগ্যদেবীর কাছ থেকে চেয়ে নিল। কিন্তু তার যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও সে সন্তুষ্ট নয় কেননা সে যা পেয়েছে ভাগ্যদেবীর শর্তানুযায়ী তার প্রতিবেশী দ্বিগুণ পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত ঐ ব্যক্তি যখন দেখতে পেল সবকিছুতেই তার প্রতিবেশী এগিয়ে যাচ্ছে তখন ভাগ্যদেবীর কাছে সে চাইল, “ হে ভাগ্যমাতা, আমার একটা চোখকে তুমি অন্ধ করে দাও।"

দিনে দিনে আমরা এই গল্পের মতো হয়ে যাচ্ছি। অন্যের ভালো আমরা কিছুতেই সহজে মেনে নিতে পারি না। আমরা মেনে নিতে পারি না কোনো পুরুষ কালো নারীকে বিয়ে করলে! আমরা মেনে নিতে পারি না কোনো পুরুষ তার থেকে বেশি বয়সী নারীকে বিয়ে করলে! আমরা মেনে নিতে পারি না অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করলে! আমরা মেনে নিতে পারি না নারী-পুরুষের বংশমর্যাদা। এখানেও আমরা উঁচু-নিচু নিয়ে প্রভেদ করি। প্রতিনিয়ত, প্রতিমুহূর্তে আমরা আমাদের মানুষ পরিচয় ভুলে যাই। কোনো দম্পতি নিজেরা সুখে আছে, যেখানে তারা একে-অপরকে মেনে নিয়েছে সানন্দে সেখানে আমরা তাদেরকে নিয়ে কুৎসা রটনায় ব্যস্ত। অথচ তাঁদেরকে আমাদের বাহ্ বাহ্ দেওয়া উচিত ছিল, উচিত ছিল উঁচু মানসিকতার অধিকারী আখ্যা দিয়ে তাঁদেরকে সংবর্ধিত করা।

কিন্তু আমরা কী করি?

কী সুন্দর নায়কের মতো ছেলেটা কী একটা মেয়েকে বিয়ে করল! 

আহারে! পরীর মতো মেয়েটা দেখেশুনে শেষ পর্যন্ত একটা প্রতিবন্ধী ছেলেকে বিয়ে করল, ওর জীবনটাই বৃথা। এভাবে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করি তাদের!

ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে আমরা অধিকাংশ মানুষ অসুখী। এই অসুখের কেবল একটাই কারণ— আমরা অপরের উন্নতিকে সহজে মেনে নিতে পারি না, অন্যের সুখ আমাদের সহ্য হয় না।

একটু কবিতার ভাষায় বলি—

 “এই ফসলের অসুখ কেন?

      অসুখ ছিল বীজেই

 আমার কোনো অসুখ নেই

    অসুখ আমি নিজেই।”

আমরা দিনে দিনে পরিণত হচ্ছি এক হিংসুটে জাতিতে। তাই অবিলম্বে আমাদের ভেতরকার এই অসুখকে দূর করতে হবে, দূর করার চর্চা করতে হবে নতুবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও এই অসুখের বীজ বহন করবে। আর এভাবে চলতে থাকলে এ জাতির ধ্বংস সময়ের ব্যাপার মাত্র।


সুখের অসুখ

তৌফিক ওমর।

২১ এপ্রিল, ২০১৮।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

স্বর্ণমালা গাঁথি বর্ণমালা দিয়ে

আমি সাধারণত শিশুদের জন্য কিছু লেখি না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কেন যেন মনে হচ্ছে আমার শিশুদের জন্য কিছু লেখা উচিত। একটা জাতির কাছে যেতে হলে প্রথ...